বৃহস্পতিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৫

অপথে সম্পদ আহরণ বনাম ইসলাম।
          অপথে সম্পদ আহরণের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ঠিক কবে, কখন, কে এর সূচনা করেছিলো দিব্যি দিয়ে বলা কঠিন। আমাদের দেশে ভাল মন্দের সাথে পরিচিতি লগ্নের শুরুতেই মানুষ জেনে যায় অপথে সম্পদ আহরণ প্রক্রিয়া চলমান। কখনো ভাই ভাইয়ের সম্পদ অপথে নিজের দখলে নেয়। কখনো স্বামীর সম্পদ অপথে প্রেমিকের হাতে তুলে দেয় প্রাণাধিকা রমনী। কখনো সম্পদকে অপথে নিজের আয়ত্মে নিতে অনেকে বিয়ের ভান করেও থাকে বলে শোনা যায়। এসব অন্যদের কথা। পরের বিষয়ে নাক না গালিয়ে নিজের ঘরের ইতিবৃত্ত স্মরণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে অনেকে বলে থাকেন, পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং অনেকে লিখিত অভিযোগ করেন যে, থানায় মামলা করতে গেলে বাদী পক্ষকে পুলিশকে টাকা দিতে হয়। মামলার চার্জশীট থেকে বাদ পড়ার জন্য বা ফাইনাল রিপোর্ট পেতে আসামী পক্ষকে, ঠিকঠাক মত চার্জশীট দাখিল করাতে বাদী পক্ষকে, জিডি করতে গেলে আবেদনকারীকে পুলিশকে টাকা দিতে হয়। কখনো কখনো মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে পুলিশ। কখনো নিরপরাধ ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করে গুরুতর মামলায় চালানের ভয় দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে কার্যবিধি ৫৪ ধারায় চালান করার অভিযোগও শোনা যায়।কোন কোন ক্ষেত্রে টাকা পয়সার পরিবর্তে অথবা টাকা পয়সার অতিরিক্ত হিসেবে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী আদায় করার বা বকশীশ, উপহার, উপঢৌকন, খুশী হয়ে দেয়া ইত্যাদি নামে টাকা বা সামগ্রী গ্রহণের অভিযোগও উত্থাপিত হয়। কথাগুলি কু-জনের রটনা ধরে নিয়েই আজকের আত্ম সমালোচনা।

          অপথে সম্পদ আহরণের ইত্যাকার কর্মগুলি দীর্ঘদিন যাবৎ জনতা ও পুলিশের মাঝে চলতে থাকায় কিছুটা সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে। কেউ দ্বীমত পোষণ করতে পারেন যে, কর্মগুলি সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। হতে পারে। তবে জনতার যে অংশ উর্দি পরার সুযোগ পেয়ে পুলিশ হিসেবে টাকা পয়সা বা মূল্যবান সামগ্রী গ্রহণ করে থাকেন,  তারা এটি পছন্দ করেন। গ্রহণকারীদের যে সকল আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু বান্ধব তাদের থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হন, তারাও এটি পছন্দ করেন। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য যারা অর্থ প্রদান করে মিথ্যা মামলা রুজু, অভিযুক্তকে গ্রেফতার ও চার্জশীট দাখিল করাতে সক্ষম হন, তারা এ সকল অর্থ প্রদানকে পছন্দ করেন। অনেক মানুষ গ্রহণ কর্মকে এতই পছন্দ করেন যে, তারা বিভিন্ন সময়ে গ্রহীতার ধণ সম্পদ নিয়ে অন্যদের সামনে গর্ববোধ করে আনন্দ পেয়ে থাকেন। অনেক মানুষ গ্রহণ কর্মকে এতই পছন্দ করেন যে, ঐ সুযোগটি না পাবার যন্ত্রনায় কাতর থাকেন এবং কিছু মানুষ সুযোগটি পাবার আশায় লালায়িত হয়ে যা যা করে থাকেন তা সকলের সামনে দৃশ্যমান। অনেক মানুষ গ্রহণ কর্মকে এতই পছন্দ করেন যে, গ্রহীতার সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে উন্মুখ। এতটাই উন্মুখ যে, সম মর্যাদার অন্য পেশার পাত্র পেলেও অনেকেই কণ্যা সম্প্রদানের ক্ষেত্রে পাত্র হিসেবে পুলিশ অফিসারকে অগ্রাধিকার দেন একই কারণে। কিছু লোক দুর্ণীতি পরায়ন লোকের দানের মোটা টাকা মসজিদ-মাদ্রাসায় গ্রহণ করতে পছন্দ করেন। অন্যান্য সংস্থার অবৈধ লেনদেনে তৎপর কিছু মানুষ পুলিশের লেনদেনকে পছন্দ করেন এ কারণে যে, তাদের নিবৃত করার একটি মেকানিজম পুলিশ বাহিনী অন্তত নিজেরা অপকর্ম করে নির্বিকার থাকুক। ইত্যাকার বিবিধ অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় বিষয়টি অনেকটাই সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বেরসিক কিছু মানুষের অবস্থান এর বিপরীতে। আবার তাদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে বলেই মনে হয়।

          সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি পাক বা না পাক দন্ডবিধি‘র ১৬১ ধারা থেকে তৎপরবর্তী কয়েকটি ধারায়, ১৯৪৭ সালের দূর্ণীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৫৭ সালের দূর্ণীতি দমন আইন এবং পুলিশ রেগুলেশন বেঙ্গল অনুসারে কর্মটি এখনো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। উক্ত বিধি বিধানের যথাযথ প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এ সকল অপরাধের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে কর্মগুলিকে নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তারপরও এ অপতৎপরতা না কমে বৃদ্ধির মাত্রাকে প্রলম্বিত করছে। যা কর্মটির সামাজিক স্বীকৃতিরই কিছুটা ইঙ্গিত বহন করে।

          আশার কথা হচ্ছে স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে উর্ধতন থেকে অধস্তন পর্যায়ে তৈরী হয়েছে অসংখ্য অফিসার যারা ঐ কর্মগুলিকে নিজেরা শুধু বর্জনই করেছেন তা নয় বরং এসবের বিপক্ষে রয়েছে সুদৃঢ় অবস্থান। যাঁদের সাথে জনগণের সম্যক পরিচিতির ব্যর্থতা এবং তাঁদের কাঙ্খিত সেবা থেকে জনতার বঞ্চনাই বলে দেয় যে, কর্মটি কিছুটা হলেও সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে।

          বাস্তবিক অর্থে কি শুধু পুলিশই এমন অবৈধ লেন-দেন বা অপথে সম্পদ আহরণের প্রতিযোগীতায় লিপ্ত? অন্যদের অবস্থা কি? হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আমি অন্যদের ত্রুটি বের করে পুলিশকে নিষ্কলুষ বলতে চাচ্ছি। বিষয়টি তা নয়। পাঠক অন্যান্য দায়িত্বশীলদের দিকে তাকালে অন্তত স্বীকার করবেন যে, হেন লেনদেন কর্মটি কিছুটা হলেও সামাজিকতা পেয়েছে বলেই স্বাধীন বাংলার বিভিন্ন সংস্থায় নানাবিধ প্রক্রিয়ায় বিষয়টি স্বগৌরবে টিকে আছে। আমি তো অবশ্যই সে সকল পুলিশের পক্ষে যাদের কথা  উপরোক্ত সর্বশেষ কলামে উল্লেখ করেছি। অন্যদের বিষয়ে এ জন্যই বলছি যে, এ দেশের জনগণ হিসেবে জমি জমার খাজনা-দাখিলা, মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমার যে সাধারণ নাগরিক অধিকার রয়েছে তাও পদে পদে বিঘ্নিত হয় লেন-দেন প্রক্রিয়াটি অন্যান্য ক্ষেত্রে চালু থাকার সুবাদে। যে নেয় তাকেও দিতে হয়। যে না নেয় তাকেও দিতে হয়। অন্যথায় আপনার মত অবস্থা হয়, যেমনটি আপনি থানায় যেয়ে পেয়ে থাকেন।

          যারা এহেন আধা সামাজিক এবং আধা অসামাজিক কর্মটি করে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ নেই। তাদের হেন কর্মের শাস্তিদাতাও আমি নই। পুলিশের কিতাবে আমি যে সকল কর্তব্যের কথা লেখা দেখেছি তার আলোকে আমি শুধু কামনা করি এদেশের সকল আম জনতা ভাই-বোন যেন থানা, কোর্ট, ডিএসবি, ডিবি এবং অন্যান্য শাখার পুলিশের কাছ থেকে ন্যায় সঙ্গত আচরণটুকু পায়। অবশ্য যারা হেন কর্মের সাথে জড়িত দৃশ্যত তারাও আমার মত চান তার ভাই যেন পুলিশের কাছ থেকে ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার পায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এবং অপ্রিয় সত্য হচ্ছে নিজে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকাকালে অন্যের ভাইয়ের সাথে তেমনটি আচরণ করেন না।

          আমার এ লেখা তাদের জন্য নয়, যারা মনে করেন দুনিয়াই সব। দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও-দাও ফুর্তি কর। পড়াশোনা করতে যেয়ে আমার নজরে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে অপথে সম্পদ আহরণ সংক্রান্ত যে তথ্যগুলি উদ্ভাসিত হয়েছে তা প্রচার করাই আমার উদ্দেশ্য। যেমনঃ

          যারা থানায় বা অন্যত্র বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে উপরে বর্ণিত কর্মগুলি চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের শেষ বিচার দিবসে (The last day of judgement) দুনিয়াতে তাদের যে দায়িত্ব ছিল সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যেমনটি বর্ণনা করা হয়েছে ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ বুখারী শরীফ ৪র্থ খন্ডের ৩২০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ২৩৮৯নং হাদীসেঃ “আবুল ইয়ামান(র.).......আব্দুল্লাহ ইবনে উমর(রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং নিজ অধীনস্থদের বিষয়ে সে জিজ্ঞাসিত হবে। ইমাম(শাসক) একজন দায়িত্বশীল। কাজেই আপন অধীনস্থদের বিষয়ে সে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল। কাজেই সে তার অধীনস্থদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের দায়িত্বশীল। কাজেই সে তার অধীনস্থদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। আর খাদিম তার মনিবের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কাজেই সে তার দায়িত্বাধীন বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। (আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.) বলেন, আমি নবী(সা.) থেকে এদের সম্পর্কে (নিশ্চিতভাবেই) শুনেছি। তবে আমার ধারণা, নবী(সা.) আরো বলেছেন, আর সন্তান তার পিতার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কাজেই তার দায়িত্বাধীন বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। মোটকথা তোমাদের প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্তদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।(একই হাদীস বর্ণিত হয়েছে ই.ফা.বা প্রকাশিত সহীহ মুসলিম শরীফের ৪৫৭৩নং হাদীসে)

          ই.ফা.বা প্রকাশিত সহীহ মুসলিম শরীফের ৪৫৭৭নং হাদীসে রয়েছেঃ “শাইবান ইবনু ফাররুখ(র.)....হাসান(র.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, উবাইদুল্লাহ ইবনু যিয়াদ মাকিল ইবনু ইয়াসার(রা.)কে দেখতে যান যে অসুখে পরবর্তীতে তিনি মারা যান। মাকিল তাঁকে বলেনঃ আমি তোমার কাছে রাসুলুল্লাহ(সা.)র নিকট থেকে আমার শ্রুত হাদীস বর্ণনা করবো। যদি আমি জানতাম যে, আমার আরও আয়ু আছে তবে আমি তোমার কাছে তা বর্ণনা করতাম না। আমি রাসুলুল্লাহ(সা.)কে বলতে শুনেছি, যে বান্দাকে আল্লাহ প্রজা সাধারণের উপর দায়িত্বশীল করেন অথচ সে যখন মারা যায় তখনও সে তার প্রজা সাধারণের প্রতি প্রতারণাকারী থাকে তবে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দেন।

          সুতরাং, উল্লিখিত হাদীসের আলোকে আল্লাহ আমাদেরকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। যেন শেষ বিচার দিবসে দায়িত্বের জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন না হতে হয়। কিংবা অধীনস্থ জনগণের সাথে প্রতারণার দায়ে জাহান্নামী না হতে হয়।

          যে সকল ভাই বোন উক্তরুপ পন্থায় উপর্জিত অর্থ সম্পদকে এখনো বৈধ মনে করার দুঃসাহস দেখান নি তাদের জন্য সুরা ২ বাকারা ১৮৮নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না। এবং জনগণের সম্পদের কিয়দংশ জেনে-শুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে শাসন কর্তৃপক্ষের হাতেও তুলে দিও না।”

          এছাড়াও সুরা ৪ নিসা এর ২৯নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি দয়ালু।

          উপরের বক্তব্য কোন গাউছ, কুতুব, পীর-ফকির, ইমাম সাহেবের, মনিষীর বা মানুষের নয়। কোন বন্ধু যদি আল্লাহতে বিশ্বাস করে থাকেন, তবে আল্লাহর এ বানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আসুন অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা থেকে এখনই এ মুহুর্ত থেকে বিরত হই। আল্লাহর করুনায় সিক্ত হই। অপারগ হলে প্রস্তুতি নেই জাহান্নামের শাস্তির জন্য।

          আমাদের অনেকে মনে করে থাকেন লোকেরা খুশী হয়ে কিছু দিলে নিতে দোষ নেই। এমন সুফী হারাম খোর আমাদের সমাজে অল্প কিছু দেখা যায়। এমন বিশ্বাসের কারণে তাদেরকে নিয়মিত নামাজ রোজা সহ অন্যান্য ধর্মীয় কাজও সাড়ম্বরে করতে দেখা যায়। আসুন! তাদের বিষয়টি কেমন জেনে নেই। আসলেই কি লোকে খুশী হয়ে টাকা পয়সা, উপহার, উপঢৌকন দেয়? আর দিলেও কি নেয়া যায়?

          যারা দাবী করেন যে, লোকেরা কারো কাজে সন্তুষ্ট হয়ে টাকা পয়সা, উপঢৌকন ইত্যাদি দেয়। কথাটা কতটুকু ঠিক? যারা এ যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে নিচ্ছেন, তারা বলুন তো যে অফিসে দায়িত্ব পালনের সাথে কারো খুশী অখুশীর বিষয় জড়িত নেই। অর্থাৎ যেখানে টাকা পয়সা লেনদেনের প্রচলন নেই সে অফিস চলছে কিভাবে?  কই সেখানে তো কেউ খুশী হয়ে কাউকে টাকা দেয় না। আপনাকে দেয় কেন?  আপনি জীবনে ক‘জনকে খুশী হয়ে বেতনের টাকা দিয়ে দিয়েছেন? ভিখারী, অভাবগ্রস্থকেই বা ক‘দিন কয় টাকা দিয়েছেন। মানুষ শুধু আপনার কাজে খুশী হয়েই টাকা দেয়। আপনি নেন কোন অধিকারে? বরং এসব অজুহাতে আপনি দূর্ণীতির একটা ফাঁদ পেতে রেখেছেন মাত্র। এমন লোকের শঠতা প্রকাশ পায় যখন খুশী হওয়ার ভান করে মানুষ অঘোষিত ভাবে নির্ধারিত লেনদেন অপেক্ষা কম দেয়। অর্থাৎ নির্ধারিত আছে ১০০ টাকা । সেক্ষেত্রে যদি খুশী হয়ে ১ টাকা দেয় তবেই বেরিয়ে যায় সুফী ঘুষখোরের আসল চেহারা! এমন ক্ষেত্রে ১ টাকা দিয়ে তাকে অপমান করা হয়েছে বলেও প্রকাশ করেন। কিন্তু খুশী হয়ে যা দেয় তাতে তো আপত্তি বা অপমানের বিষয় আসার কথা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে ঘুষখোরের ঘুষ নিতে লজ্জা করে না, লজ্জা হয় অন্যায়ভাবে অর্জিত অর্থকে ঘুষ বললে।

        আসুন বন্ধু! খুশী হয়ে উপঢৌকন দেয়া নেয়ার ব্যাপারে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ(সা.)র বক্তব্য জেনে নেই। যিনি আল্লাহর শেখানো কথাই মানুষকে শুনিয়েছেন।

          ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ বুখারী ১০ম খন্ডের ৩২৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ৬৫০৮নং হাদীসে যে বর্ণনাটি রয়েছে তা হলঃ
উবায়াদ ইব্ন ইস্মাঈল (র) .......... আবূ হুমায়দ সাঈদী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্(সা) লুতাবিয়্যা নামে এক ব্যক্তিকে বণী সুলায়ম গোত্রের যাকাত আদায়কারী নিয়োগ করলেন। যখন সে ফিরে এলো তখন তিনি তার কাছ থেকে হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করলেন। সে বলল, এগুলো আপনাদের মাল, আর এগুলো (আমাকে দেয়া) উপঢৌকন। তখন রাসূলুল্লাহ্(সা) বললেনঃ যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে তোমার মা-বাবার ঘরে বসে থাকলে না কেন? সেখানেই তোমার কাছে উপঢৌকন এসে যেত। এরপর তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করার পর তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের কাউকে এমন কোন কাজে নিয়োগ করি, যার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে আল্লাহ্ আমাকে মনোনীত করেছেন। কিন্তু সে কাজ সম্পাদন করে এসে বলে, এ হল তোমাদের মাল। আর এ হলো আমাকে দেয়া উপঢৌকন। তাহলে সে কোন তার মা-বাবার ঘরেই বসে রইল না, সেখানে এমনিতেই তার কাছে তার উপঢৌকন এসে যেত? আল্লাহর কসম! তোমরা যে কেউ অবৈধভাবে কোন কিছু গ্রহণ করবে, সে কিয়ামতের দিন তা বয়ে নিয়ে আল্লাহর সামনে হাযির হবে। আমি তোমাদের কাউকে ভালভাবেই চিনব যে, সে আল্লাহর কাছে হাজির হবে উট বহন করে, আর উট আওয়ায দিতে থাকবে। অথবা গাভী বহন করে, আর সেটা ডাকতে থাকবে। অথবা বক্রী বহন করে, আর সেটা ডাকতে থাকবে। এরপর তিনি আপন হাতে দু’টি এতদূরে উত্তোলন করলেন যে, তাঁর বগলের শুভ্রতা দেখা যাচ্ছিল। তিনি বললেন, হে আল্লাহ্! আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? আমার চক্ষুযুগল সে অবস্থা অবলোকন করেছে এবং আমার কান শুনেছে।

          বন্ধুগণ! হাদীসের বর্ণনা আল্লাহর ফায়সালা। রাসুলুল্লাহ(সা.) শুধু ফায়সালার বিষয় উম্মতের কাছে পৌছে দিয়েছেন। হাদীসটির মর্মার্থ বুঝতে সম্ভবত কষ্ট হওয়ার কথা নয়। হাদীসের ভাষ্য অনুসারে এটা স্পষ্ঠভাবে প্রকাশিত যে, পদে থাকা দায়িত্বশীল লোকদেরকেই ক্ষমতার অপব্যবহারের ভয়ে মানুষ খুশী হওয়ার ভান করে, মূলত বাধ্য হয়ে উপহার, উপঢৌকন ইত্যাদি নামে ঘুষ দেয়। পদের বাইরে যারা আছে তাদেরকে কেউ খুশী হয়ে দেয় না, এটাই সত্য। যা আল্লাহর রাসুল(সা.) আজ থেকে অনেক শতাব্দি আগে বলে গিয়েছেন। এখানে কোন লোকের নিজস্ব ছল চাতুরী করে ভিন্ন অজুহাত প্রতিষ্ঠা করার আর সুযোগ নেই।

          আমাদের অনেকেই অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাগে অপথে গ্রাস করে চলেছে এবং পাশাপাশি পূণ্যকর্ম করছে। অনেকে এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, পাপ-পূণ্যের পরিমাপে আমার পূণ্যের পাল্লা ভারী হয়ে আমাকে জান্নাতে যেতে সাহায্য করবে। অনেকে এ আশায় পাপের পথে, অন্যায়ভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে মসজিদ বানায়, এতিমখানায় দেয়, গরীব মিসকিনকে খাওয়ায়, দান খয়রাত করে। যে পদ্ধতি অনেকটা আমাদের দেশের বাংলা সিনেমার নায়কের মত। নায়ক যেভাবে ডাকাতি করে আনা লুটের মালামাল দান খয়রাত করে হিরো বনে যায়। তেমনই প্রচেষ্টা। কিছু আলীম শ্রেণীর লোক তাদেরকে হাদীসের কথা শুনিয়ে এথেকে বিরত থাকার নসীহত না করে এভাবে মসজিদ বানাতে ও দান খয়রাত করতে উৎসাহিতও করে থাকে। যার প্রমাণ সমাজে ভুরি ভুরি রয়েছে। ফলে ব্যাক্তি মসজিদ, মাদ্রাসা প্রভৃতি সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে অপথে সম্পদ আহরণ প্রতিরোধে ভুমিকা রাখতে উৎসাহিত হওয়ার পরিবর্তে দূর্ণীতি করতে উৎসাহী হয়।

          আসুন ইসলামী শরিয়ত মতে পাপ-পূণ্য একসাথে করে জান্নাত লাভের বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব সেটা হাদীস থেকে জেনে নেয়ার চেষ্টা করি।

ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম শরীফের ৪২৬নং হাদীসঃ “মুসআব ইবনে সা‘দ(র.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ ইবনে আমের রুগ্ন থাকাকালে একদা আব্দুল্লাহ ইবনে উমার তাকে দেখতে (সৌজন্যমূলক পরিচর্যা করার উদ্দেশ্যে) গেলেন। অতপর ইবনে আমের বললেনঃ হে ইবনে উমার! আপনি অবশ্যই আমার জন্যে দোয়া করুন। জবাবে ইবনে উমার(রা.) বললেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ(সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ পবিত্রতা ছাড়া নামায কবুল হয় না এবং আত্মসাৎ বা খেয়ানতের সম্পদ থেকে সাদকা কবুল হয় না। অথচ তুমি ছিলে বসরার শাসক।” (ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত তিরমিযি শরীফ ১ম খন্ডের ৫পৃষ্ঠায় বর্ণিত ১নং হাদীসেও অনুরুপ বর্ণনা রয়েছে)

          ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম শরীফ ৩য় খন্ডের ৩৩০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ২২১৫নং হাদীসঃ আবু কুরায়ব মুহাম্মদ ইবনুল আলা(র.)......... আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ(সা.) বলেন, হে লোক সকল!  আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “হে রাসুলগণ!  তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর ও সৎকর্ম কর, তোমরা যা কর, সে সম্বন্ধে আমি অবহিত” (সুরা মুমিনুনঃ ৫১) তিনি আরো ইরশাদ করেন, “হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে আমি যেসব পবিত্র বস্তু দিয়েছি, তা থেকে আহার কর”।(সুরা বাকারাঃ ১৭২) এরপর নবী(সা.) এক ব্যাক্তির কথা উল্লেখ করলেন যে, দীর্ঘ সফর করে যার এলোমেলো চুল ধুলায় ধুসরিত সে আকাশের দিকে দুহাত তুলে বলেঃ “হে আমার প্রতিপালক!  হে আমার প্রতিপালক!  অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোষাক-পরিচ্ছদ হারাম এবং তাঁর শরীর গঠিত হয়েছে হারামে। অতএব, তাঁর দুআ কিভাবে কবুল করা হবে?

          ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত তিরমিযি শরীফ ৪র্থ খন্ডের ৩৬২ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ১৯১১নং হাদীসে মজলুম, পিতামাতা এবং সফরকারীর দোয়া নিশ্চিত কবুলের কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল(সা.) সেই সফরকারীর বিষয় উল্লেখ করে স্পষ্ঠ করে দিলেন যে, আল্লাহ হারাম উপায়ে উপার্জিত অর্থের সদাকা গ্রহণ করেন না এবং হারাম পোষাক পরিহিত ও হারাম রুজী দ্বারা পরিপুষ্ট দেহের অধিকারী বান্দার দোয়াও কবুল করেন না।

          তাহলে যিনি অনুরুপ আশা পোষণ করে অন্যের সম্পদ গ্রাস করে চলেছেন আশাকরি উক্ত হাদীস গুলি তাকে কৃতকর্ম থেকে বিরত রাখবে। যদি তিনি আল্লাহ ও রাসুলে(সা.)র প্রতি সত্যিকারের ইমানদার হয়ে থাকেন। কেননা, তার অপথে উপার্জিত সম্পদের দান, খয়রাত, সাদাকা কিছুই আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হবে না। উপরন্তু হারাম পোষাক, হারাম রুজিতে পরিপুষ্ট শরীর নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাত তোলার ফলাফল শুন্য। সুতরাং ফিরে আসুন কোরআন সুন্নাহর পথে। আমরা সকলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হালাল রুজিতে তৃপ্ত থাকতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দিন।

          কিছু মানুষ অন্যায়ভাবে অর্থ সম্পদ আহরণ করে যেটা করে তা স্পষ্ঠ জুলুম। কখনো জুলুমের শিকার ব্যাক্তিকে ভুল বোঝানো হয় বলে সে অবৈধ টাকা প্রদান করে আর জুলুমবাজের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়াও করে থাকে। যেমন কখনো কোন ব্যাক্তিকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে এনে বোঝানো হয় তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। অন্তত কয়েকটি মামলায় চালান করার জন্য উপর থেকে হুকুম এসেছে। ইত্যাকার কথাবার্তা বলে শিকার ব্যাক্তিকে বোঝানো হয় যে, কিছু টাকা খরচ করলে নিতান্ত মানবিক কারণে তাকে হালকাভাবে ৫৪ ধারায় চালানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গুরুতর অপরাধের মামলায় চালান থেকে রেহাই দিয়ে ৫৪ ধারায় চালানকে ব্যক্তির প্রতি সুবিচার করা হয়েছে এবং মানবিকতা প্রদর্শন করে জুলুমবাজ বিরাট মহানুভবতার কাজ করেছে ভেবে লোকেরা টাকাও দেয়, দোয়াও করে। আসুন ব্ন্ধু! এমন জুলুমবাজের পরকালীন পরিণতি জেনে নিতে চেষ্টা করি।

          ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ বুখারী শরীফ ৪র্থ খন্ডের ২৫১ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ২২৮৭নং হাদীসঃ “আদম ইবনে আবু ইয়াস(র.).......আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সা.) বলেছেন, যে ব্যাক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রম হানী বা অন্য কোন বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সে দিন আসার পূর্বে যে দিন তার কোন দীনার বা দেরহাম থাকবে না। সে দিন তার কোন সৎকর্ম থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ তা তার নিকট থেকে নেওয়া হবে আর কোন সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ থেকে নিয়ে তা তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।”

          ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত  ৬৩৪৩নং হাদীসঃ কুতাইবাহ ইবনে সাঈদ ও আলী ইবনে হুজর(র.)....... আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ(সা.) বলেনঃ তোমরা কি বলতে পার, অভাবী লোক কে? তারা বললেন,  আমাদের মাঝে যার দিরহাম ও ধন সম্পদ নেই সে তো অভাবী লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মাতের মধ্যে সে প্রকৃত অভাবী লোক, যে ব্যাক্তি কিয়ামাতের দিন সলাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে, অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের সম্পদ ভোগ করেছে, অমুককে হত্যা করেছে ও আরেকজনকে প্রহার করেছে। এরপর সে ব্যাক্তিকে তার নেক আমাল থেকে দেয়া হবে, অমুককে নেক আমাল থেকে দেয়া হবে। এপর যদি পাওনাদারের হাক্ক তার নেক আমাল থেকে পূরণ করা না যায় সে ঋণের পরিবর্তে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”

          ই.ফা.বা কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত  ২২৯১নং হাদীসঃ “আলী ইবনে হুজর(র.).......আবু সাঈদ খুদরী(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(সা.) মিম্বরের উপর বসলেন। আমরাও তাঁর চতুর্পার্শ্বে বসলাম। তারপর তিনি বললেন, আমার তিরোধানের পর তোমাদের ব্যাপারে আমি যে সব আশংকা করি এর মধ্যে প্রধানতম বিষয় হচ্ছে পার্থিব জাঁকজমক ও এর চাকচিক্য। তখন এক ব্যাক্তি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কল্যাণ কি অকল্যাণ আনতে পারে? এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ(সা.) নিরব থাকলেন। তাঁকে বলা হল, তোমার কি ব্যাপার তুমি তো রাসুলুল্লাহ(সা.)র সাথে কথা বলছ। আর তিনি তোমার সাথে কথা বলছেন না। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমরা লক্ষ্য করলাম যে, তাঁর উপর ওহী নাযিল হচ্ছে। তারপর তিনি স্বাভাবিক হয়ে নিজের ঘাম মুছে ফেলে বললেন, প্রশ্নকারী কোথায়? মনে হল, তিনি তার প্রশ্ন পছন্দ করেছেন। এরপর তিনি বললেন, কল্যাণ কখনো অকল্যাণ আনে না। অবশ্য বসন্ত কাল যা কিছু উদগত করে (ভক্ষণকারী) পশুকে পেট ফুলিয়ে মেরে ফেলে বা মৃত্যুর নিকটবর্তী করে দেয়। কিন্তু যে তৃণভোজী পশু তা খায় এমন কি যখন তার উভয় কোক পূর্ণ হয়ে যায় তখন সে উত্তাপ গ্রহণ করে, এরপর সে মল ত্যাগ ও পেশাব করে এবং পূনরায় চরতে যায়। মরে রাখবে, এ ধন সম্পদ সবুজ শ্যামল ও মধুর। এ সম্পদ ঐ মুসলমানের উত্তম সঙ্গী যে এ থেকে মিসকিন, ইয়াতিম ও মুসাফিরদেরকে দান করে। অথবা রাসুলুল্লাহ(সা.) যে শব্দ বলেছেন। আর যে ব্যাক্তি এ সম্পদ অবৈধভাবে উপার্জন করে সে ঐ ব্যাক্তির মত যে ভক্ষণ করে কিন্তু তৃপ্ত হয় না। অধিকন্তু কিয়ামতের দিন এ সম্পদ তার বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে।”

          আজকে যে লোক সুযোগ পেয়ে নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে, জুলুম করে, কখনো প্রতারণামূলকভাবে ইত্যাদি অসাধু প্রক্রিয়ায় অপথে অন্যের সম্পদকে হস্তগত করছে তা ফিরিয়ে দিয়ে মাফ নেয়ার এখনো সময় ও সুযোগ রয়েছে। অন্যথায় সে সম্পদ কিয়ামতে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে। বিচার দিবসে অন্যায়ভাবে আহরিত সম্পদের পরিবর্তে মজলুমকে পূণ্য দ্বারা বদলা দিতে হবে। পূণ্য শেষ হলে মজলুমের জুলুম পরিমাণ পাপ নিজের উপর বর্তাবে। দুনিয়াতে অন্যায়ভাবে আহরিত কোটি টাকার সম্পদের মালিক সত্বেও এমন ব্যাক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। হাদীসগুলি সহীহ বা বিশুদ্ধ অর্থাৎ অবশ্য অবশ্যই নবী(সা.) কথাগুলি বলেছেন। এখনো আমরা যদি সজাগ না হই, সচেতন না হই তাহলে অনিবার্য পরিণতির জন্য প্রস্তুত হই। অবৈধ পথে উপার্জনের দুনিয়াবী শাস্তি হচ্ছে ব্যাক্তির সম্পদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তৃপ্ত হতে পারেন না। ফলে অতৃপ্ত জীবনে সার্বক্ষণিক সে অর্থ সম্পদের পিছনে ছুটে বেড়ায়।

          সুরা ৬৪ তাগাবুন এর ১৫নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষাস্বরূপ। আর আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাপুরস্কার।”

          আমরা অনেকেই সন্তান-সন্ততির উজ্জল ভবিস্যত গড়ার আশায় অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে সংগ্রহ করে পুঞ্জিভুত করে থাকি। আমরা যদি এমন করি তাহলে ধরে নেয়া যায় যে, আমরা নির্ধারিত পরীক্ষায় ফেল করেছি অর্থাৎ সন্তানের প্রতি দয়া, মায়া ও ভালবাসায় আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে আল্লাহর নিকট হতে মহা পুরস্কার প্রাপ্তি থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছি।

          সুরা ৮ আনফাল এর ২৮নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,“ আর জেনে রাখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি অকল্যাণের সম্মুখীনকারী। বস্তুতঃ আল্লাহর নিকট রয়েছে মহা সওয়াব।

          সুরা ৬৩ মুনাফিকুন এর ৯নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।”

          সুরা ৬৪ তাগাবুন এর ১৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,“ হে মুমিনগণ, তোমাদের কোন কোন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের দুশমন। অতএব তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। যদি মার্জনা কর, উপেক্ষা কর, এবং ক্ষমা কর, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুনাময় “

          আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন যে, সন্তান-সন্ততি আমাদেরকে অকল্যাণের মুখোমুখী করে, আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে কখনো তারা আমাদের দুশমন হয়ে দাড়ায়। এটা তখনই সম্ভব যখন আমরা পরিবারের কল্যাণার্থে অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ হস্তগত করি তখনি আমাদের সন্তান-সন্ততি আমাদের জন্য অকল্যাণের উপকরণ হয়ে যায়। যখন পরিবারের অন্যায় আবদার মিটাতে আমরা আল্লাহর বিধানকে অমান্য করে অন্যের সম্পদ হস্তগত করার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়ে পড়ি তখনি আমাদের সন্তান-সন্ততি আমাদের জন্য আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল থাকতে সাহায্যকারী এবং কখনো আমাদের দুশমন হয়ে দাড়ায়। কেননা, তাদের কল্যাণ করার অন্যায় প্রচেষ্ঠা আমাদেরকে জাহান্নামে পৌছে দিয়েই ক্ষান্ত হয়। আমরা প্রকৃতপক্ষে তাদের কল্যাণ বিবেচনা করে আল্লাহর বিধান অমান্য করতে উৎসাহিত হই। আমরা যদি সন্তান-সন্ততির অন্যায় আবদার বা চাহিদা উপেক্ষা করে আল্লাহর বিধান প্রতিপালনে মনোযোগী হই তবেই আল্লাহকে পাওয়া যাবে ক্ষমাশীল হিসেবে। অন্যথায় নয়।

          বন্ধুগণ! সুরা নং ৫১ জারিয়াত এর ৫৬নং আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন যে, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শুধুমাত্ত তার ইবাদাত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর নির্দেশনা পালনের মাধ্যমেই ইবাদাত সম্পন্ন হয়। বিরোধীতা করে নয়। সুরা ৩ আল ইমরাণের ১১০নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে, আমাদেরকে আল্লাহ সর্বোত্তম উম্মত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সর্বোত্তম উম্মত হওয়ার শর্ত হচ্ছে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। কিন্তু আমরা যদি তা না করে নিজেরাই বরং অসৎ কাজের কাজী হয়ে পড়ি তবে আমরা যে মুহাম্মাদ(সা.)কে নবী বলে স্বীকার করে নিজেকে মুসলিম বলে দাবী করি। কোন মুখে কিয়ামত দিবসে সে নবী(সা.)র সামনে হাজির হব। তিনি কি আমাদের জন্য সুপারিশকারী হবেন?

          আমরা যারা অন্যের ধন সম্পদ অন্যায়ভাবে হস্তগত করে নিজেরই উপর জুলুম করেছি, তাদের জন্য আল্লাহকে সন্তুষ্টির শেষ সুযোগ হিসেবে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ঠ দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।যেমনঃ

          সুরা ৩৯ যুমার আয়াত ৫৩ আল্লাহ বলেন,“ বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

          সুরা ১৫ হিজর এর ৫৬নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তিনি বললেনঃ পালনকর্তার রহমত থেকে পথভ্রষ্টরা ছাড়া কে নিরাশ হয়?”

          সুরা নং ২৯ আনকাবুত আয়াত ২৩ আল্লাহ বলেন,“ যারা আল্লাহর আয়াত সমূহ ও তাঁর সাক্ষাত অস্বীকার করে, তারাই আমার রহমত থেকে নিরাশ হবে এবং তাদের জন্যেই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।

          সুতরাং, আসুন বন্ধু! আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে জান্নাত লাভের আশায় অতীতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাই। যিনি আল্লাহর নির্দেশিত পথে ফিরে আসতে চান তার জন্য আল্লাহ যে উপায় রেখেছেন তা হলঃ

সুরা ৪ নিসার ১৭নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভূলবশতঃ মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে; এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, রহস্যবিদ।”

          সুতরাং, আসুন বন্ধু! আমরা যদি এতদিনের অন্যায় কর্মকে ভুল মনে করে থাকি, তবে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করি। যাদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে যতটুকু সম্ভব তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই। আর চিরদিনের জন্য ফিরে আসি, এমন দুর্ণীতির কুপথ থেকে। আশা করা যায়, আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন।

          আমাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা এমন সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন যে, চাকরীর শেষে সবকিছু বাদ দিয়ে ইবাদাত বন্দেগীতে লিপ্ত হয়ে একবারে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে আল্লাহ ওয়ালা হয়ে যাবো। এমন লোকের প্রতি আল্লাহর মেসেজ হচ্ছেঃ

          সুরা ৪ নিসা‘র ১৮নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আর এমন লোকদের জন্য কোন ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকেঃ আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।

          আল্লাহ আমাদের সকলকে আল কোরআনুল করীম ও সহীহ সুন্নাহ পড়ে, জেনে, বুঝে, মেনে চলার তাওফিক দান করুন ও জান্নাতি হিসেবে কবুল করে নিন। আমীন।

----------------০----------------